শীতের তীব্রতা, রুক্ষতা ও শুষ্কতা ত্বকের ওপর যে প্রভাব ফেলে, তাকে আগত গ্রীষ্ম ঋতুর জন্য প্রস্তুত করার সময় হচ্ছে এই বসন্তকাল। অর্থাৎ শীত ও গ্রীষ্মের মধ্যে সংযোজন ঋতু হচ্ছে বসন্ত। শীতকালে সাধারণত আমাদের রক্তনালীগুলো কিছুটা সংকুচিত হয়। সেই সাথে সেরাম যা প্রাকৃতিকভাবে ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে এবং সোয়েট গ্ল্যান্ড এর উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। সে কারণে ত্বককে একটু নিস্তেজ দেখায়। এই জন্যই সাধারণত সবাই অভিযোগ করে যে, শীতে ত্বক অনেকটাই কালো হয়ে গেছে অথবা ত্বক আগের থেকে উজ্জ্বলতা হারিয়েছে। ত্বকের বসন্তকালীন পরিচর্যা নিয়ে লিখেছেন দেশের বিশিষ্ট ডার্মাটোলজিস্ট ডা. তাওহীদা রহমান ইরিন।
পরিবেশ যখন শুষ্ক হতে থাকে, তখন সে প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের ত্বক থেকে আর্দ্রতা শুষে নিতে থাকে। আর এই কারণেই ত্বক শুষ্ক হতে থাকে। আবার অনেকেই ভাবে সানস্ক্রিন শুধুমাত্র গ্রীষ্মকালের জন্য বা রোদ থেকে ত্বককে সুরক্ষার জন্য, তাই শীতকালে ব্যবহার করে না। এছাড়া শীতকালে সবাই একটু উৎসবমুখর থাকে, বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান হয়, ছুটিতে যায়, সমুদ্র সৈকতে যায়, বিয়েশাদির ধুম লেগেই থাকে। এর ফলে ঠিকমতো ত্বকের যত্ন নেয় না। মেকআপে নির্ভরশীল হয়ে থাকে, মেকআপ পরিষ্কার করে না, নতুন নতুন পণ্য ব্যবহার করতে থাকে। যেহেতু ত্বক শুষ্ক থাকে, ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করে ঠিকই তবে তা ত্বকের ধরণ অনুযায়ী হয় না। এর ফলে ত্বকে নানা ধরণের সমস্যা দেখা দেয়।
আবহাওয়ার খবরে বলা হয়েছে – এবারে শীতের তীব্রতা যেহেতু বেশি ছিল, তাই গ্রীষ্মের উষ্ণতাও অনেক তীব্র হবে। সে কারণেই আমাদের ত্বককে আরও বেশি করে সুরক্ষিত রাখতে হবে। পরিবেশের সাথে মোকাবেলা করার জন্য ত্বকের বহিরাবরণ বা বেরিয়ারটা যেনো ঠিক থাকে। সেই সঙ্গে পিএইচ ব্যালেন্স ঠিক থাকে এবং আর্দ্রতাসহ সব কিছুর যেনো ভারসাম্য থাকে।
বসন্তের মর্নিং স্কিন কেয়ার রুটিন বা এএম স্কিন কেয়ার রুটিন, নাইট স্কিন কেয়ার রুটিন বা পিএম স্কিন কেয়ার রুটিন সেটি আমরা কী ধরণের ব্যবহার করবো ? সাধারণত শীতে একটু ভারী টেক্সচার বা ক্রিম টাইপ ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা হয়। বসন্ত থেকেই আমরা একটু লাইট ওয়েট টেক্সচারের ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করবো গ্রীষ্মের প্রস্তুতি হিসেবে। অনেকেই যেটা করেন, গ্রীষ্মকালীন যে প্রোডাক্টগুলো ব্যবহার করবেন, সেগুলো একবারেই না করে শীতের যে প্রোডাক্টগুলো ব্যবহার করছেন সেটি এএম কেয়ারে রাখুন আর গ্রীষ্মের প্রোডাক্টটি রাখুন পিএম কেয়ারে। অথবা আপনি আপনার পছন্দমতো এএম, পিএমের ময়েশ্চারাইজারও পরিবর্তন করতে পারেন ত্বকের ধরণ অনুযায়ী।
ত্বকের যত্নে বর্তমানে আমরা ৩ টি জিনিস খুব আলোচনায় রাখছি, সেগুলো হচ্ছে স্কিন লেয়ারিং, স্কিন সাইক্লিং এবং হাইব্রিড স্কিন কেয়ার। এক্ষেত্রে স্কিন লেয়ারিং মর্নিং স্কিন কেয়ারে রাখবো, সাইক্লিংটি নাইট স্কিন কেয়ারে রাখবো, আর হাইব্রিড স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টের মাধ্যমে আমি এই দু’টোতে সমন্বয় করবো ইভনিং স্কিন কেয়ারে বা এএম পিএম স্কিন কেয়ারে। মর্নিং স্কিন কেয়ারে আমরা প্রথমেই ফেস ওয়াশ করে নেবো। ক্লিনজারটিতে যেনো এমন উপাদান থাকে যা একই সাথে আমাদের আর্দ্রতা, হাইড্রেশন, ময়েশ্চার লক করে এবং ত্বকে যাদের রুক্ষতা, শুষ্কতা, পিগমেন্টেশন বা ব্রণের দাগ থাকে সেগুলোকে যেনো হালকা করে। এরকমই একটি উপাদান হচ্ছে ক্যামোমাইল এক্সট্রাক্ট অর্থাৎ ক্যামোমাইল ফুলের নির্যাস যা ত্বকের জন্য হাইব্রিড প্রোডাক্ট হিসেবে কাজ করে।
এরপর আসছি ময়েশ্চারাইজারে। যারা টিনএজার, তারা হায়ালুরোনিক এসিডযুক্ত এবং যাদের একটু ম্যাচিউর স্কিন তারা পেপটাইডযুক্ত সেরাম ব্যবহার করবেন। কেনোনা পেপটাইড, কোলাজেন ও ইলাস্টিনকে বুস্ট করে এবং ম্যাচিউর স্কিনের জন্য এটি এন্টি এজিং ফাইটার হিসেবে কাজ করে। এএম স্কিন কেয়ারে আপনি ফেস ক্লিন করে সাথে সাথেই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করবেন। কোনো সময় দেবেন না লেয়ারিংয়ে। কিন্তু ময়েশ্চারাইজারের পর আপনি যে, থার্ড স্টেপ (সানস্ক্রিন) এএম স্কিন কেয়ারে ব্যবহার করবেন সেটি ২ মিনিট পরে ব্যবহার করবেন। ফেস ওয়াশটি ১ মিনিট ম্যাসাজ করে ফেস ক্লিন করবেন এবং ময়েশ্চারাইজার ২ মিনিট ধরে ম্যাসাজ করে এপ্লাই করবেন। তাহলে আপনার ফেসিয়াল ম্যাসাজও হবে, ত্বকে রক্ত চলাচলও ভালো হবে, লিম্ফেটিক ড্রেনেজ হবে, ফেস কনটোর থাকবে, মাসলগুলো রিল্যাক্স হবে, টেনশন রিলিজ হবে এবং প্রোডাক্টও সুন্দর ভাবে ত্বকে শোষিত হবে। তবে সানস্ক্রিনটি ময়েশ্চারাইজার ব্যবহারের ২ মিনিট পরে ব্যবহার করবেন। সেক্ষেত্রে হাইব্রিড স্কিন কেয়ারে সানস্ক্রিন যেটি পছন্দ করবেন সেটি একাধারে স্কিনের সান প্রোটেকশনও করবে, ময়েশ্চারাইজারের কাজও করবে এবং আপনি যদি বাহিরে যান তা প্রাইমার হিসেবেও কাজ করবে মেকআপের আগে। মেকআপ ছাড়াও আপনি অনেক সময় বাইরে, স্কুল – কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে গেলেও এটি ব্যবহার করতে পারেন। এতে আপনি একটি নো মেকআপ লুক পাবেন যেটি কিন্তু এখনকার মেকআপ ট্রেন্ড। এতে নিয়াসিনামাইড, রাইস ওয়াটার এক্সট্রাক্ট, জোজো ব্লসম মানে ফ্লাওয়ার এক্সট্রাক্ট থাকে এবং আমাদের খুব পছন্দের এলজি বা শৈবাল এক্সট্রাক্ট থাকে। যার ফলে আমাদের ত্বক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং ত্বকে তারুণ্যভাব আসে।
এবার আসছি পিএম স্কিন কেয়ার রুটিনে। পিএম স্কিন কেয়ারে ডাবল ক্লিনজিং করবেন মাইসেলার ওয়াটার দিয়ে। প্রথমে ক্লিন করে সারাদিনের ধুলাবালি, ইম্পিওরিটিস দূর করবেন। এরপরে আপনি যে ফেস ক্লিনজার ব্যবহার করছেন সেটি দিয়ে মুখ ধুবেন। আমাদের তথাকথিত যে সাইক্লিং সেটি হচ্ছে প্রথম রাতে আমরা এক্সফোলিয়েশন করি, দ্বিতীয় রাতে রেটিনল ব্যবহার করি এবং তৃতীয় রাতে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করি। কিন্তু বাংলাদেশের তাপমাত্রা অনুযায়ী আমি যেভাবে কাস্টোমাইজ করি সেটি হচ্ছে, প্রথম রাতে এক্সফোলিয়েশন, ডাবল ক্লিনজিং করে আপনি ফিজিক্যাল এক্সফোলিয়েটর দিয়ে স্ক্রাব করে নিলেন। এরপরে স্লিপিং মাস্ক দিবেন যেটি এক্সফোলিয়েটরের কাজও করবে এবং ময়েশ্চারাইজারের কাজও করবে। সাধারণত এখানে আরবিউটিন, ট্রানেক্সামিক এসিড, নিয়াসিনামাইড এবং গ্লাইকোলিক এসিড থাকে বা ম্যান্ডেলিক এসিড খুব অল্প পরিমাণে থাকে। দ্বিতীয় রাতের রুটিনে আপনি রেটিনলের জায়গায় আমি কোনো একটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট যুক্ত এন্টি এজিং সেরাম ব্যবহার করতে বলি সেটি আপনার পছন্দমতো যেমন আমি ব্যক্তিগতভাবে এডিলয়েস ফ্লাওয়ার এক্সট্রাক্ট যুক্ত এন্টি এজিং পেপটাইড সেরাম ব্যবহার করতে বলি। তৃতীয় রাতে আপনি একটি প্লেইন ময়েশ্চারাইজার, যারা টিনএজার তারা হায়ালুরোনিক এসিড, যারা একটু ম্যাচিউর স্কিন তারা পেপটাইড সেরাম ব্যবহার করবেন। প্রথম রাতে এক্সফোলিয়েশন হয়, দ্বিতীয় রাতে স্কিন রিনিউয়াল ও রিজেনারেশন হয়, তৃতীয় রাতে স্কিন রিপেয়ার এবং চতুর্থ রাতে স্কিন ময়েশ্চারাইজ থাকে। তাহলে এক্সফোলিয়েশন, রিজুভিনেশন, রিপেয়ার এই সাইকেলটি মেইনটেইন করতে পারেন। ভালো থাকেন, ভালোবাসা দিবসে সকলকে শুভেচ্ছা। বসন্ত ও ভালোবাসায় আপনার আগামী দিনগুলো সুন্দর হয়ে উঠুক।