এই গল্পটি ঈশপের নাকি কার লেখা এখন আর ঠিক লেখকের নামটা মনে নেই আমার। শৈশবে এটি পড়ানো হতো ইংরেজি গল্প থেকে বাংলায় তরজমা করে। মনে হয় আমরা এটি সিক্স কিংবা সেভেন ক্লাসে পড়েছিলাম, পাশ করে উপরের ক্লাসে ওঠার জন্যে।
কিন্তু…
আচ্ছা এই কিন্তুর কারণটা একটু পরেই বলি, আসুন মাঝ বয়সে এসে একটু কষ্ট করে সেই শৈশবের গল্পটা আজ আবার পড়ি। হয়তো আবার পড়লে নিজের জীবনের আয়নায় এখন নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করে ইউরেকা বলে চিৎকার করতেও পারি…।
তাহলে আসুন গল্পটা আবার পড়ি:
“একদা একটি বড় ব্যাঙ একটা ছোট পুকুরে বাস করত। পুকুরের সবচেয়ে বড় প্রাণী হওয়ার কারণে, ব্যাঙ সিদ্ধান্ত নিল, তাকে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় জিনিস হতে হবে। সে যখন পদ্মপাতার বিছানায় রোদ উপভোগ করেছিল, তখন অহংকারে তার বুক ফুলে উঠল। ‘আমার চেয়ে বড় কোথাও কেউ নেই,’ সে ভাবল।
একদিন একটি অনেক বড় আকারের ষাঁড় পুকুরে পানি পান করতে এল। ব্যাঙ অবাক হয়ে গেল, কিন্তু সে প্রভাবিত হতে চাইল না। ব্যাঙ ষাঁড়টিকে ডেকে বলল, ‘হে ষাঁড় তুমি নিজেকে বড় মনে করো। কিন্তু, তুমি জানো যে আমি নিজেকে তোমার মতো বড় করতে পারি।’ ষাঁড়কে ব্যাঙ চিৎকার করে বলল, ‘তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস না করো, শুধু দেখো!’ ব্যাঙটি একটা গভীর শ্বাস নিল এবং নিজেকে ফুলিয়ে তার স্বাভাবিক আকারের দ্বিগুণ করে তুলল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ষাঁড় তার দিকে কোনো মনোযোগ দিল না। ‘তাহলে, এটা তোমার জন্য যথেষ্ট বড় নয়?’ ব্যাঙ বলে উঠল। ‘খুব ভালো। আমি নিজেকে আরও বড় বানাব।’ সে পেট ফুলিয়ে আরও বড় করে তুলল। তারপরও ষাঁড় কিছু বলল না। সে সাধারণভাবে কেবল মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। পুকুরে পান করার জন্য যথেষ্ট পানি ষাঁড়টি পেয়েছিল। ষাঁড়ের সাড়া না পেয়ে ব্যাঙ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। বিশাল পরিমাণ শ্বাস নিয়ে, বারংবার শ্বাস নিয়ে..শ্বাস নিয়ে ফেটে যাওয়া পর্যন্ত নিজেকে ফোলাল সে। এবং এটি ছিল ছোট পুকুরের বড় ব্যাঙের শেষ। তাই, যা হতে পারবে না, কেউ তা হওয়ার চেষ্টা করবে না।”
গল্পটার সারকথাতো এখানেই শেষ হলো। একবার ভাবুনতো শৈশবে আমাদেরকে কেন এই গল্পটি পড়ানো হয়েছিলো। শুধুই একটা ক্লাস পাশ দেয়ার জন্যে? নাকি জীবন নামক ক্লাসে নিজের বোধকে পাশ করানোর জন্যে?
সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্টির ভারসাম্যের জন্যে শক্তি, মেধা, সাহস, রঙ ও আকারে ভিন্নতা করেছেন। সেটি প্রাণিকুলের সর্বস্তরেই। গল্পটির মুলেও তাই বলা হয়েছে। বিধাতা আবার প্রাণিকুলের সবার রিজিকটা নিজেই নিয়ন্ত্রণ করেন। তাহলে আমারও একটা আকার ও মেধার ছাঁচ আছে। তিনি সেই ছাঁচেই আমাকে দেখতে বা রাখতে পছন্দ করেছেন। ওই ছাঁচের একটা সীমাও তিনি আমার মধ্যে দিয়ে রেখেছেন। সেটি হোক আমার আকার কিংবা মেধা। আমি যদি আমার সেই অমোঘ ও অনিবার্য নিয়তিকে মেনে না নিয়ে সীমা লংঘন করতে চাই তাহলে কী আমার অবস্থা ওই ব্যাঙের মতো হবে না?
“নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা লংঘনকারীকে পছন্দ করেন না।”
কোনো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়িয়ে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দা মুহাম্মদ (সা.)কে বিশ্বনবী করে জগৎ পাঠের গুরু বানিয়েছেন।
মেধা কমের অযুহাতে স্কুল থেকে বের করে দেয়া সেই শিশু টমাস আলভা এডিসনকে একসময় জগৎ সেরা বিজ্ঞানী করেছেন।
আবার জগৎজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের রিজিক অল্প আয়ূতেই তুলে নিয়েছেন।
তার মানে সবার জীবনের মানচিত্রটা তৈরি ওই বিধাতার হাতে, তিনিই সেখানে আমার আপনার রিজিক লিখে রেখেছেন। তাঁর সেই মানচিত্রের সীমা অতিক্রম করা আমার ও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গল সেখানেই নিহিত।”
যেখানে সৃষ্টির সব অহংকার মহান আল্লাহর, তাহলে আমি আপনি কেন কর্মে ও ব্যবসার সাফল্য নিয়ে কিংবা লেখাপড়ায় মেধা তালিকায় নিজেকে দেখে এত অহংকারের প্রতিযোগিতায় লড়ছি। আল্লাহতো “অহংকারীদের পছন্দ করেন না।”
অপরদিকে কর্মে ও ব্যবসায় মন্দা এলে কিংবা লেখাপড়ায় অকৃতকার্য হলে কেন নিজেকে হতাশায় নিমজ্জিত করি? কেন ভুলে যাই আল্লাহ তাঁর মানচিত্রে আমাকে এভাবেই দেখতে চেয়েছেন। নিশ্চয়ই এতেও আমার জন্যে তাঁর দেয়া কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
আমরা ভুলে গেলে চলবে না যে, মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাকে সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সৎকর্ম করতে বলেছেন। সফল হতে চেষ্টা করতেও বলেছেন, তবে সেই চেষ্টাটুকু নিজের সাধ্যের মধ্যে থেকে। সীমা অতিক্রম করে চেষ্টা করতে বলেননি।
পরকালে তিনি বান্দার কাছ থেকে সম্পদ আর সন্তানের বিষয়েই হিসেবটা কঠিনভাবে নেবেন। তাই এই দু’টিতে সীমা লংঘন করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
আর তাই অন্যের সম্পদ আর সন্তানের মেধার জৌলুসতা দেখে ঈর্ষাকাতর না হয়ে সষ্টার সৃষ্ট মানচিত্রে নিজের অবস্থা ও অবস্থানের সীমায় থাকাই অধিক মঙ্গলের। ওই কথায় বলে না- “অনিবার্য নিয়তিকে মেনে নেয়াই শ্রেয়।”
[লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সংগঠক, তানভীর আলাদিন ]